বাংলা নববর্ষ: বাঙালি চেতনার দীপ্ত প্রেরণা
পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে একত্র করে এক আনন্দময় মিলনমেলায়। নববর্ষ উদযাপন শুধু একটি বর্ষবরণের উৎসব নয়, বরং এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়, ঐতিহ্য ও জাতিসত্তার প্রকাশ।
নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার এই দিনটি প্রতীক হয়ে ওঠে আশাবাদ, কল্যাণ ও নতুন জীবনের। পুরনো বছরের গ্লানি ভুলে নব আশা ও সম্ভাবনার আলোয় স্নাত হয়ে ওঠে বৈশাখের সকাল। জাতীয় সংগীত ও ‘এসো হে বৈশাখ’ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নববর্ষের অনুষ্ঠান সূচিত হয় দেশজুড়ে।
বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য বহন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করা এই শোভাযাত্রা আজ বাঙালি সংস্কৃতির গর্ব।
বাংলা সনের সূচনা মুঘল সম্রাট আকবরের সময়, মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজে খাজনা আদায় ও কৃষিকাজের সুবিধার্থে। শুরুর দিকে এটি ছিল ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত, পরবর্তী সময়ে তা রূপ নেয় ‘বঙ্গাব্দ’-এ। বাংলা সন সূর্যোদয়ের সঙ্গে দিন গণনার এক বৈচিত্র্যপূর্ণ উদাহরণ, যা চাঁদের হিজরি ও ঘড়ির খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার থেকে আলাদা।
একসময় বাংলা নববর্ষের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল হালখাতা—ব্যবসায়ীদের পুরনো দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলার উৎসব। মিষ্টিমুখ, আমন্ত্রণ ও পারস্পরিক শুভেচ্ছার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠত নতুন সম্পর্কের সেতুবন্ধন। এই ঐতিহ্য আজও জীবন্ত।
স্বাধীনতার পর নববর্ষ শুধুমাত্র উৎসবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি হয়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। ষাটের দশকে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বর্ষবরণ হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা, ঐক্যের প্রতীক।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও বাংলা নববর্ষ পেয়েছে স্বীকৃতি। ২০২৫ সালের ৭ এপ্রিল নিউইয়র্ক স্টেট সিনেট চেম্বারে প্রথমবারের মতো ১৪৩২ বঙ্গাব্দ উদযাপিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এই ঐতিহাসিক উদ্যোগে ভূমিকা রেখেছেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিত সাহা। টাইমস স্কয়ারে নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাঙালির সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হচ্ছে।
পহেলা বৈশাখ মানেই বৈশাখী মেলা—বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির রঙিন রূপ। ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, পোশাক, অলংকার ও পণ্য যেমন বাঙালির শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, তেমনি পান্তা-ইলিশ, পিঠা, দই-চিড়ার মত খাবার প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। মেলাতে বাউল গান, যাত্রা, পুঁথিপাঠ থেকে শুরু করে নাগরদোলা আর সার্কাস—সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় এক সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক জগৎ।
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন নয়, এটি একটি দর্শন—যেখানে উঠে আসে সমানাধিকারের আহ্বান, অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র এবং জাতির ঐক্যের বার্তা। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’—এই চেতনা ধারন করেই এগিয়ে যাবে বাঙালি জাতি।
বৈশাখ এসেছে তার বার্তা নিয়ে—আলোকিত হোক নতুন বছর, প্রাণবন্ত হোক বাঙালির সংস্কৃতি।
0 comments:
Post a Comment