একদিকে শান্ত জলের পুকুর, হালকা হাওয়ায় ঢেউ তুলতে কাঁপছে চাষের প্রান্ত। অন্যদিকে সরু মাটির রাস্তা, চারপাশে কিছু তাল গাছ আর ঝোপঝাড়ের ফাঁকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি একাকী তালগাছ। এটি যেন গ্রামীণ বাংলাদেশের এক চেনা, চিরন্তন দৃশ্য। তালগাছ হয়তো এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না, কিন্তু এর অস্তিত্ব হারায়নি। আজও গ্রামের পুকুরপাড় বা রাস্তার ধারে এক-আধটি তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের উপস্থিতি জানান দেয়।
এই তালগাছই আজও আশ্রয় হয়ে রয়েছে এক শিল্পী পাখির—বাবুইয়ের জন্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাবুই পাখি তালগাছের পাতায় তাদের ঘর বানিয়েছে। যদিও আজকাল এই গাছ ও পাখির সংখ্যা অনেকটা কমে গেছে, তবুও কিছু স্থানে এখনো দেখা যায় তাদের চমৎকার নির্মাণ—বাবুইয়ের বাসা।
মৌলভীবাজারের গয়ঘর গ্রামের একটি তালগাছে চোখে পড়েছে এক চমৎকার দৃশ্য। তালপাতায় গাঁথা অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা পথচলতি মানুষের নজর কাড়ছে। গ্রামের বাসিন্দা মো. আমির জানালেন, এক সময় এই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে এখন তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায়, এমন বাসা দেখা যেন সৌভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক বিকেলে গয়ঘর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, একটি বাড়ির পুকুরপাড় ঘেঁষে আকাশের দিকে মাথা তুলেছে তালগাছ, যার ডালে ছড়িয়ে আছে বাবুইয়ের বাসা। কিছু বাসা তৈরি হয়ে গেছে, আবার কিছু এখনও নির্মাণাধীন। বিকেল গড়াতে বাবুই পাখিরা তাদের বাসায় ঢুকে পড়ছে। কেউ ভিতরে প্রবেশ করছে, কেউ বা পাশের জায়গায় বসে পরিবেশের পর্যবেক্ষণ করছে। এই দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব এবং জীবন্ত।
বাবুই পাখির বাসা যেন প্রকৃতির আঁকা নিখুঁত শিল্পকর্ম। জটিল কাজ হলেও বাবুই পাখি খুব সূক্ষ্মভাবে ঠোঁট ব্যবহার করে এগুলো তৈরি করে। গ্রীষ্মকালে তাদের প্রজননের সময়। পুরুষ বাবুই একত্রিত করে খাঁটি তাল, খেজুর, ধান এবং ঘাসপাতা, যেগুলোর পাতলা আঁশ দিয়ে গাছের ডালে একের পর এক গিঁট বাঁধে। এরপর ঠোঁট দিয়ে সেলাইয়ের মতো করে তৈরি করে বাসা। বাসা প্রস্তুত করতে সময় লাগে সাত থেকে দশ দিন। এরপর স্ত্রী বাবুই আসে, ডিম পাড়ে, ছানা ফোটে, এবং কিছু সময় পরে তারা উড়তে শেখে।
একটি বাসায় তিনটি ডিম পেড়েছে স্ত্রী বাবুই। ডিম থেকে ছানা বের হতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৩ দিন। আর ছানাগুলি উড়তে শেখে ১৫ থেকে ১৯ দিনের মধ্যে। বাবুই পাখির আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এদের দেখা পাওয়া যায়।
সন্ধ্যার দিকে গয়ঘরের আরেকটি তালগাছের নিচে দেখা গেল, বাবুইদের কিছু নতুন বাসা তৈরি হচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসছে, আর ধীরে ধীরে তাদের কিচকিচ শব্দ শোনা যাচ্ছে। চারপাশে এক নিঃশব্দতা ছড়িয়ে পড়েছে, যেন প্রকৃতি গভীর ঘুমে।
এভাবেই হয়তো বাবুইদের বাসা অনুপ্রাণিত করেছিল কবি জনীকান্ত সেনকে তাঁর বিখ্যাত কবিতায়:
“বাবুই পাখিরে ডাকিব বলিছেছড়াই,
কুঁড়েঘরে থাকতে করশিল্পের বড়াই…
বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তাহায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকিনিজেরবাসায়।”
হয়তো বাবুইর মতো এ মাটির মানুষও তাই বলে—সুখ না থাকলেও, তবুও নিজস্ব গড়া ঘরে শান্তি আছে। কারণ ঘর মানে শুধু আশ্রয় নয়, এটি ভালোবাসা, পরিশ্রম এবং গর্বের প্রতীক।
0 comments:
Post a Comment