নবী নূহ (আ.)-এর পুত্র সাম ছিল হজরত সালেহ (আ.)-এর পূর্বপুরুষ। তিনি সামুদ জাতির নবী ছিলেন, যাদের বসবাস ছিল হিজাজ ও সিরিয়ার মা
ঝখানে অবস্থিত ওয়াদিউল কুরা অঞ্চলে, যা আজ 'মাদায়েন সালেহ' বা 'ফায্জুহুনাকাহ' নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক মাসউদি বর্ণনা করেছেন যে, সিরিয়া থেকে হিজাজ যাওয়ার পথে এখনো সামুদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতির চিহ্ন দেখা যায়।
সামুদ ছিল ঐশ্বর্যশালী এবং পরাক্রমশালী। তারা পাহাড় কাটতে বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। সোনায় এবং রূপায় ভরপুর জীবনযাপন করছিল, কিন্তু তবুও তারা আল্লাহকে অস্বীকার করছিল এবং বহু উপসনার পূজা করছিল। এই জাতির মধ্য থেকেই উদয় হন হজরত সালেহ (আ.)—একজন জ্ঞানী, সুবক্তা ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি।
নবুয়তের আহ্বান
সালেহ (আ.) যখন নবুয়তের দায়িত্ব পান, তখন তিনি তার জাতিকে ডাক দিয়ে বলেন—
“হে আমার সম্প্রদায়, আল্লাহর ইবাদত করো। তিনিই ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং এই জমিনে স্থাপিত করেছেন। তাঁর কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁরই দিকে ফিরে এসো।” (সুরাহ হুদ: ৬১)
তবে তার আহ্বানে সাড়া দেয় না বেশিরভাগ মানুষ। তারা সম্পদ, প্রাসাদ ও গর্বে আত্মমগ্ন হয়ে প্রশ্ন তোলে, “আমাদের মধ্য থেকেই কি তা কেন নবী বানানো হয়েছে?” (সুরা সাদ: ৮)
অলৌকিক উটের নিদর্শন
তারাও সালেহ (আ.)-এর কাছে নবুয়েতের প্রমাণ চাইলে বলল, যদি তিনি সত্যিই আল্লাহর রাসুল হন, তবে "কাতেবা" নামের পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, স্বাস্থ্যবান উট বের করে দেখাচ্ছেন। সালেহ (আ.) তাদের ইমান আনানোর শর্তে তাদের প্রার্থনা গ্রহণ করে আল্লাহর কাছে আহ্বান করেন।
আল্লাহর কুদরতে সেই অলৌকিক উট সত্যিই বেরিয়ে আসে পাথুরে পাহাড় ফুঁড়ে। কোরআনে এই প্রাণীকে “আল্লাহর উট” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ এটি দেখে ইমান আনলেও, অধিকাংশই ফেরারিদের প্ররোচনায় বিরত থাকে।
এই ঘটনা সামুদ জাতির জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল, কিন্তু তারা তা অগ্রাহ্য করে।
সালেহ (আ.)-এর সতর্কবার্তা ও সামুদ জাতির ধ্বংস
হজরত সালেহ (আ.) সামুদ জাতিকে সতর্ক করে বললেন—
“এই উট আল্লাহর নিদর্শন। তাকে আল্লাহর জমিনে স্বাধীনভাবে চলতে দাও। তাকে কোন ক্ষতি করো না, নতুবা কঠিন আজাব আসবে।” (সুরাহ হুদ: ৬৪)
💧 পানি ভাগাভাগির বিদ্রোহ
উটের জন্য নির্ধারিত ছিল একদিন, অন্য দিনগুলো ছিল মানুষের জন্য। উট একদিন পানি পান করলে কূপ শূন্য হয়ে যেত। প্রথমদিকে তারা উটকে সম্মান করলেও পরে বিরক্ত হতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ‘মিসদা’ ও ‘কাসার’ নামে দুই যুবক প্রলোভন পেয়ে উটটিকে হত্যা করে।
আল্লাহ বলেন—
“তারা উটটিকে হত্যা করল এবং তাদের প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তারপর বলল, হে সালেহ! এখন তোমার ভয় দেখানো আজাব এনে দেখাও, যদি তুমি সত্যিকার রাসুল হও।” (সুরা আরাফ: ৭৭)
🌩️ ধ্বংসের পূর্বাভাস
সালেহ (আ.) তাদেরকে জানিয়ে দেন—
“আরও তিন দিন তোমরা নিজেদের ঘরে থাকো, এরপর আসবে আল্লাহর আজাব।” (সুরাহ হুদ: ৬৫)
প্রথম দিনে তাদের চেহারা হলুদ, দ্বিতীয় দিনে লাল এবং তৃতীয় দিনে কালো হয়ে যায়। চতুর্থ দিনে, শনিবার সকালে, আকাশে বিধ্বংসী গর্জন, বজ্রপাত ও ভূমিকম্প ঘটে।
“ভোরবেলায় তারা নিজেদের ঘরে ধ্বংস হয়ে পড়ে।” (সুরা আরাফ: ৭৮)
🔍 শিক্ষণীয় বার্তা
এই কাহিনী আমাদের শেখায়—
- আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকার করলে তাঁর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
- অহংকার, অবাধ্যতা, এবং ঈমান থেকে বিমুখতা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
- আল্লাহর নবীদের সতর্কবানী সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ও সত্য।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর নিদর্শন থেকে শিক্ষার তাওফিক দিন। আমিন।
0 comments:
Post a Comment