তিমির মূত্র: সমুদ্রের অদৃশ্য পুষ্টি সরবরাহকারী এবং জলবায়ুর অতন্দ্র রক্ষক

লিখেছেন: বিজ্ঞান প্রতিবেদক | প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই ২০২৫
সমুদ্র জুড়ে ঘুরে বেড়ানো এই বিশাল স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমি ভূমিকা রাখে শুধু সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষাতেই নয়, বরং পরোক্ষভাবে স্থলভাগের পরিবেশেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রথমবারের মতো পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে যে, তিমির মূত্রও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এক অপ্রত্যাশিত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।
সম্প্রতি Nature Communications জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জানানো হয়, বিশেষ কিছু প্রজাতির তিমি প্রতিদিন প্রায় ৯৫০–১০০০ লিটার মূত্র ত্যাগ করে। এই মূত্র সমুদ্রজলে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সরবরাহ করে, যা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের বৃদ্ধিতে সহায়ক। সালোকসংশ্লেষণের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বছরে বায়ুমণ্ডল থেকে গড়ে ১৮,১৮০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে — যা বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
তিমির মূত্র ও পুষ্টিচক্র: প্রকৃতির সার কারখানা
প্রাপ্তবয়স্ক ব্লু হোয়েল বা স্পার্ম হোয়েল প্রতিদিন শত শত লিটার মূত্র ত্যাগ করে, যা সমুদ্রের পানিতে মিশে গিয়ে এক ধরনের প্রাকৃতিক সার হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াকে “whale pump” নাম দিয়েছেন—যার মাধ্যমে তিমিরা গভীর সমুদ্র থেকে পুষ্টি উপরে নিয়ে আসে ও তা ছড়িয়ে দেয় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকায়।
তাদের চলাচলের কারণে পুষ্টি উপাদান যেমন নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সমুদ্রের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে স্থানান্তরিত হয়। পুষ্টি-স্বল্প অঞ্চলে তিমিরা তাদের মূত্রের মাধ্যমে একটি নতুন খাদ্যজাল সৃষ্টি করে, যা প্ল্যাঙ্কটন থেকে শুরু করে মাছ, পাখি ও সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী পর্যন্ত বিস্তৃত।
জলবায়ু রক্ষায় তিমির পরোক্ষ অবদান
সালোকসংশ্লেষণকারী ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন সমুদ্রজলে CO₂ শোষণ করে এবং অক্সিজেন উৎপাদন করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তিমির উপস্থিতি ও মূত্রের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া প্রায় ৪০% পর্যন্ত কার্যকর হয়। অর্থাৎ তিমি না থাকলে সমুদ্রের কার্বন শোষণ ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে কমে যেতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তন আরও ত্বরান্বিত করবে।
সমুদ্রের সংকট ও তিমির বিপন্নতা
বর্তমানে মানবসৃষ্ট দূষণ, অতিরিক্ত মাছ ধরার চাপ, জাহাজ চলাচল এবং শব্দদূষণের কারণে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। আশঙ্কাজনক হারে কমছে তিমির সংখ্যা, যা সমুদ্রের পুষ্টিচক্র ও বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
নতুন গবেষণাগুলোর মাধ্যমে এখন এটা স্পষ্ট যে তিমি কেবল প্রাণীর রাজ্যের এক বিস্ময়কর সদস্যই নয়, বরং তারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এক অতন্দ্র প্রহরী। তাই শুধু সংরক্ষণ নয়, আমাদের এখন তিমির বাসস্থান রক্ষা, খাদ্য সরবরাহ ও চলাচলের পথ সুরক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে।
উপসংহার
তিমির মূত্র হয়তো প্রথম শুনতে তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু এটি আসলে এক জটিল ও মহৎ পরিবেশগত প্রক্রিয়ার অংশ। এটি আমাদের শেখায়, প্রকৃতিতে এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলোর গোপন অবদান ছাড়া পুরো বাস্তুতন্ত্রই ভেঙে পড়তে পারে। তাই তিমিকে বাঁচানো মানে, সমুদ্রকে বাঁচানো; আর সমুদ্রকে বাঁচানো মানে, পৃথিবীকে রক্ষা করা।
0 comments:
Post a Comment